বন্ধুত্ব ও বাস্তবতা | পর্ব - ১
______________________________________________________________________________
দৃশ্যপট ১
১৩ এপ্রিল, সকাল ৯টা । মধুমতি নদীর পাড়ে অনেক্ষনযাবত বসে আছে প্রায় ৬০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। চুল দাড়ি একেবারে ধবধবে সাদা হয়ে গেছে তার। বসে বসে কি যেনো বিড়বিড় করছে আর তার চোখের কোণা দিয়ে বেয়ে পড়ছে জল। পথচারী অনেকেই এসে জানতে চাইছে তার আসলে কি হয়েছে সে এখানে বসে কান্না করছে কেনো। কারো কথায় কোনো পাত্তাই দিচ্ছেন না তিনি। পরণে বেশ দামি পাঞ্জাবি আর কাশমিরি শাল তাতে দেখে কেউ আবার পাগল বলার সাহসও পাচ্ছে না। আসলে এই গ্রামের এপ্রজন্মের মানুষেরা কেউই তাকে চিনে না। এই জগতে কাউকে দেখার সময় কারো নেই। সবাই যার যার মত আবার নিজের কাজে চলে যাচ্ছে।
_______________________________________________________________________________
দৃশ্যপট ২
গ্রামের একদিক থেকে হঠাত করে বেশ কিছু মানুষের শোড়্গোল শোনা গেলো। সবাই মিলে কিছু একটা নিয়ে খুব হাকডাক করছে। হাকডাক শুনে সেই বৃদ্ধ চোখ মুছে একটু এগিয়ে গেলেন কি হয়েছে বোঝার জন্য। গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ীতে তার নাতি হয়েছে। সেই নাতির কিছু জামাকাপড় রোদে দেওয়া ছিলো তাই নিয়ে ময়লা করে দিয়েছে এই গ্রামেরই এক পাগলি শাহিদা। সেই নিয়ে চেয়ারম্যনের সাঙ্গু পাঙ্গুরা খুব ক্ষেপেছে আর কি। শাহিদা পাগলি একটা সময় তাদের মতই স্বাভাবিক মানুষ ছিলেন তার অনেক সম্মান ছিলো এই গ্রামে ।কিন্তু কে বা মনে রেখেছে ? সময়ের সাথে সবাই ভুলে যায় মানুষদের। নদী ভাঙ্গনে ছেলে শফিক স্বামী জব্বার চকিদার কে হারানোর পর থেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে এই শাহিদা পাগলি। সেই যাই হোক সেই শোড়গোলে হঠাত করে শাহিদা পাগলি চিল্লায় উঠে বললো '"আমার তুরাব আইছে" আর হাত দিয়ে তাক করলো সেই ৬০ বছর বয়সী মানিষটাকে। শাহিদা পাগলির মুখে যেই প্রশান্তি দেখা গেলো তা আর কখনো এই গ্রামবাসী দেখেনি। সবাই চুপ হয়ে গেলো কারণ এগ্রামের বয়স্ক সবাই খুব ভালো করে চিনে এই তুরাব মিয়াকে।
_________________________________________________________________________________
তুরাব চৌধুরী, পোশাক শিল্পের এক সফল ব্যাবসায়ীর নাম। ঢাকা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল মিলে তার প্রায় অর্ধশতাধিক মিল আর গারমেন্টস রয়েছে। এতো বড় ব্যাবসায়ী হওয়া সত্তেও প্রতিবছর এই ১৩ এপ্রিল আসলেই তিনি চলে আসেন এই গ্রামে আর সকাল থেকে বসে থাকেন এই মধুমতি নদীর পাড়ে। এলাকার মসজিদে নামাজ পড়েন এলাকাবাসীর মঙ্গল কামনা করে এলাকার মসজিদে মিলাদ দেন। এবারও ঠিক সেই কাজই করবেন। তবে কোনোবারই তিনি নিজে সামনে থেকে এসব কাজ করেন না মসজিদ কমিটির কাছে টাকা বুঝিয়ে দেন এসব করার জন্য। এই মসজিদ করার সময় অনুদানের সিংহভাগ তুরাব চৌধুরিই দিয়েছিলেন তাই মসিজিদ কমিটির সকলে তার কথা খুব মান্য করেন। এই কারণে এই গ্রামের অনেকেই তুরাব চৌধুরিকে ভালোমত চিনে না। সেই ছোটবেলায় গ্রাম ছেড়েছিলেন তিনি তারপর আর কখনো ফিরে আসেননি থাকার জন্য। মাঝে মাঝে এরকম একদিনের জন্য এসে আবার চলে যান। গ্রামের চিকন রাস্তায় গাড়ি ঢুকালে মানুষের চলাচলের কষ্ট হবে ভেবে কখনোই নিজের গাড়ি নিয়ে গ্রামে আসেন না।
তার এসব কাজ করার কারণ এ গ্রামের কম বেশি অনেকেই জানে। বন্ধুত্বের এক অনন্য উদাহরণ এই তুরাব সাহেব। এই সবকিছুর কারণ তার বন্ধু সমীর।
তুরাব আর সমীরের মত ভালো বন্ধু খুব কম দেখা যেত সেইসময়। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারতো না। দুজনেই পড়াশুনায় বেশ ভালো ছিলো। এইবছর সমীর প্রথম হলে পরের বছর তুরাব প্রথম হতো। দারুন বন্ধুত্ব দুজনের তাই তুরাব সেই ধাক্কাটা নিতে পারেনি। সামনে বই খোলা থাকে আর তুরাব নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে , এযেনো বিশ্বাসই হয় না তার যে তার বন্ধু আর এই পৃথিবী তে নেই। তার বিশ্বাস নদি থেকে সমীর উঠে চমকে দেবে সকলকে।
সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা তাই সকালবেলা সমীর ঘরে বসে পড়ছিলো। সমীরের বাবা জব্বার চকিদার নদীর পাশে মাঠে গরু বাধতে যায় আর সমীরের মা গিয়েছিলো পাশের গ্রামে তার মামার বাড়িতে দরকারী একটা কাজে। হটাত করেই ঝড় শুরু হয় তাতে সমীরের মা আটকা পড়ে যায় তার মামার বাড়িতে। তুরাবও সেইসময় ঘরে বসে পড়ছিলো। সমীরদের বাড়ির কাছেই তাদের বাড়ি। হঠাত করে লোকজনের হৈচৈ শুনে বারান্দায় বেরিয়ে আসে তুরাব দেখলো সমীরদের বাড়িটা প্রাইয় হেলে গেছে নদীর দিকে মাঝে বিরাট ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামের মানুষেরাও কিছু করতে পারছে না। আস্তে আস্তে বাড়িটা তলিয়ে গেলো নদিতে। তুরাবের তখন খেয়াল হলো যে তার বন্ধু সমীর ঘরের মধ্যে ছিলো জোড়ে চিতকার করে উঠলো সে কিন্তু ততক্ষনে আর কিছুই করার ছিলো না। যেখানে সমীরদের বাড়িটা ছিলো সেখানে এখন নদীর ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সমীরের মা শাহিদা বেগম ধাক্কাটা নিতে পারেননি আর তিনি মানসিক ভারসাম্য হারালেন। সমীর পড়াশুনায় ভালো ছিলো মাধ্যমিক দিলে হয়তো স্টার মার্ক পেতো কিন্তু তার আগেই সব শেষ।
গ্রামের বাকি লোক তখন দিন গুনছে কবে তাদের সময় আসে। এজন্য সকলেই তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নিরাপদ দুরত্বে চলে যাচ্ছে। তুরাবের বাবা ছিলেন ভুমি অফিসের তফসিলদার তাই তাদের কোনোকিছুর অভাব ছিলো না। এজন্য তিনি তার পরিবার নিয়ে মফসসলে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন।
to be continued ........
Comments
Post a Comment