নিয়তি || ছোটগল্প by Fahim Rifat

"নিয়তি"

আমাদের পাড়ায় একটা কাক ওড়াউড়ি করে। সারাদিন ‘কা-কা-কা’ রবে গোটা পাড়া মাতিয়ে রাখে। আজ হয়েছে কী, খুব আনন্দেই ছিল সে। পাশের এলাকায় পিরের মাজারে গতরাতে ওরস ছিল। সেইসঙ্গে বিরিয়ানির ভূরিভোজ। আজ সারাদিন সেই ভূরিভোজের উচ্ছিষ্ট খেয়ে মনের সুখে এসে চুপচাপ বসেছিল আমাদের পাড়ার তিনমাথার মোড়ে রাস্তার পাশে একটা সজনে গাছের ডালে। বসন্তকাল। ডালে ডালে সজনের ফুল এসেছে। বাতাসে তার সুন্দর মিষ্টি গন্ধ আছে। সেই গন্ধে এমন ভরসন্ধ্যাতেও মৌমাছিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। যেন ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’ গান গাইছে।
ঠিক এরকম সময় আমাদের পাড়ার কাশেম হাজি মাঠ থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে। চৈতালি মৌসুম। মাঠ থেকে, খামার থেকে বাড়িতে ফসল তোলার কাজ চলছে জোরকদমে। তা বাদেও মাগরিবের নামাজ বলেও একটা ব্যাপার আছে, কিছুদিন আগে হজ করে এসেছে বলেই সেটা ধরার তাড়া ছিল তার...

কিন্তু বাড়ির সদর দরজায় এসে তাকে থমকে দাঁড়াতে হলো। সে দেখতে পেল, তার বাড়ির সদর দরজার পাশের গলিতে বসে কে একজন প্রসাব করছে। সদ্য হজ করে পবিত্র হয়েছে সে। তাছাড়া নিজের গ্রাম এবং দেশকে স্বচ্ছ করতে হাত লাগিয়েছে। আর কি না কোথাকার কে এসে তার দরজার পাশের গলিটাকে অপবিত্র করছে। এটা তার সহ্য হয় না। সে লোকটাকে জোড়েসোরে ধমক মারে, মুতবার আর জায়গা পেলা না মিয়া? বেচারা লোকটার তখন চরম অবস্থা। তার কিছু করার নেই। তখন তার প্রসাবের তীব্রতা এতই যে, কে কী বলছে তা শুনবার মতো পরিস্থিতিতেও নেই সে।

এদিকে ধমকানিতেও কাজ হয় না দেখে কাশেম হাজির রাগ আরো জোড়ালো হয়। অন্তরে ক্রোধ জাগে। তবু সবকিছু ভুলে সে এগিয়ে যায় লোকটার কাছে। মেজাজ নিয়েই বলে, তুমি কানে কালা নাকি মিয়া? আমি কী কইতাছি, তা তুমার কানে ঢুকছে না !! লোকটার তবু কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার কাজ করে যাচ্ছে। এরপর কাশেম হাজি নিজের অন্তরের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। মুখে আর কিছু বলেও না, আচমকাই পেছন থেকে লোকটার পাছায় জোরসে মারে এক লাথি। ততক্ষণে লোকটার পেচ্ছাবের তীব্রতা কমে এসেছিল, আকস্মিক এই আক্রমণে সে হকচকিত হলেও নিজেকে সামলে নেয়। শুধু সামলে নেয় না, উঠে দাঁড়ায়। আক্রমণকারী কাশেম হাজিকে দেখে। আর বুঝতে পারে আক্রমণকারীর চেয়ে তার শরীরেও তাকত কম নেই। হয়তো সেটা বোঝাতেই সেও পালটা লাথি মারে কাশেম হাজিকে। আর তার সেই লাথিতেই কাশেম হাজি একেবারে চিৎপটাং।
কাশেম হাজির কোমর ভাঙে না মাজা, কেউ বুঝতে পারে না। তবে তার কাতরানি শুনে আত্মীয়স্বজন যারা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে, তারা চটজলদি তাকে নিয়ে ছোটে কেষ্টপুর গ্রামীণ হাসপাতালের উদ্দেশে। ওই ফাঁকে লোকটাও কোথায় গায়েব হয়ে যায়।
আর যারা এমন ঘটনার সাক্ষী হতে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল তারা কাশেম হাজির হজ করে আসার পর সদ্য নিকাহ করা অল্পবয়সী বউটার ভাগ্যে কী আছে তা নিয়ে ফিসফাস আলোচনা করতে করতে নিজের নিজের বাড়ির পথ ধরে।
মসজিদে তখন মাগরিবের নামাজের আজান পড়ছে। আজান শুনে সজনে গাছের ডালে বসে থাকা কাকটার মনে হয়, কাশেম হাজির সদ্য নিকাহ করা বউটাই বুঝি কাঁদছে। সেই কান্না কাকটার সহ্য হয় না, শান্তি খুঁজতে ছুটির ডাল ছেড়ে সে মন খারাপকে সঙ্গী করে নিশ্চুপে উড়ে যায়।

পরের দিন ভোর হতে না হতে আর একটা ঘটনার সাক্ষী হয় কাকটা। সঙ্গে আমরাও। কাকটা শান্তি খুঁজতে এসে বসেছিল আমাদের পাড়ার একটা খুব প্রাচীন নিমগাছের ডালে। সেই নিমগাছের কাছেই করিমের মুদিদোকান। আমাদের পাড়ার ওই একটাই মুদিদোকান। বলা নেই-কওয়া নেই, সেই দোকানে গতরাতে চোর ঢুকেছিল। চোর শুধু ঢোকেইনি, চোর করিমের মুদিদোকানের জিনিসপত্র যতটা পেরেছে সঙ্গে নিয়ে গেছে। যা নিয়ে যেতে পারেনি, সবগুলিকে ওলঝোল করে রেখে গেছে। চালের সঙ্গে আটা মিশিয়েছে। চিনির সঙ্গে নুন। সরষের তেলের সঙ্গে কেরোসিন। তারপর করিম যে তার দোকানের মালপত্র কিনতে যাবে, সেইমতো ফর্দি আর টাকা বান্ডিল করে রেখেছিল ক্যাশবাক্সে, সেই ফর্দি আর টাকার বান্ডিলটাও চুরি করে নিয়ে গেছে। সেই দুঃখে করিম তার দোকানের সামনে বসে বসে কাঁদছে। যদিও তার কান্নায় কোনো শব্দ নেই, চোখে পানি আছে। আর বুকে আছে হাহাকার। তবে মুখে কোনো কথা নেই। মিঞাপাড়ার পিরসাহেব বেঁচে থাকলে হয়তো কথা থাকত। মিঞাপাড়ার পিরসাহেব হাত চালিয়ে ঠিক চোর ধরে দিত। দোকানের জিনিসপত্র উদ্ধার না হলেও অন্ততপক্ষে সেই বান্ডিল করা টাকা উদ্ধার হতো নিশ্চিত। মিঞাপাড়ার পিরসাহেবের সেই ক্যারিশমা ছিল। বেঁচে থাকতে তিনি অনেকের চুরি যাওয়া জিনিস উদ্ধার করে দিয়েছেন। কিন্তু ক-বছর আগেই তাঁর ইন্তেকাল হয়েছে। আমাদের পাশের গ্রামের চৌরাস্তার মাথায় তাঁর মাজার আছে। সেই মাজারে তাঁর মৃত্যুদিন উপলক্ষে ফি-বছর ওরস হয়। এই তো গত পরশু আসরের নামাজের পর থেকে শ্রোতাদের ধৈর্য পর্যন্ত ওরস হয়ে গেল। দূরদূরান্ত থেকে বড় বড় আলেম এসেছিল বক্তা হয়ে। আমাদের গ্রাম তো আমাদের গ্রাম, পাশাপাশি গ্রাম বাবুপুর, ধুমপাড়া, চকপাড়া, পলাশবাটি, জয়রামপুর, বাথান, শিমুলিয়া, রমজানপুর থেকে লোকজনও সেসব বড় বড় আলেমের বক্তব্য শুনতে এসেছিল। করিম নিজেও গিয়েছিল ওই ধর্মীয় আলোচনায়। সেই ফাঁকেই শালা চোর করিমের দোকানে চুরি করেছে। করিমের তাই খুব মনখারাপ। নিঃশব্দে সে শুধু কাঁদছে। চোখের পানি তার বুকের ভেতর থেকে থেকে হাহাকার হয়ে বেরিয়ে আসছে...

খবরটা শুনে আমরা যে যেখানে ছিলাম, ছুটে এসেছি। দেখতে দেখতে সেখানে রীতিমতো ভিড় জমে গেছে। বাচ্চা-বুড়ো, মেয়ে-ছেলে। আমরা সবাই নিয়ামতের তছনছ হওয়া দোকানটাকে দেখছি। করিমকেও দেখছি। সময়ে-অসময়ে করিম আমাদের ধার দেয়। চাল-ডাল-নুন-তেল। স্বভাবতই আমাদের সবার মনখারাপ হবারই কথা। তবে আমরা সবাই করিমের মতো কাঁদতে পারছি না। ব্যাপারটা নিয়ে শুধু ভাবছি। কে চুরি করতে পারে, মনে মনে অনুমান করছি। তা নিয়ে ফিসফাস আলোচনাও করছি। আমাদের পাড়ায় চোর বলতে তো ছিল আবুল চোর! কিন্তু সে কবেই চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গণপিটুনিতে মারা গেছে। আমাদের পাড়ায় তাহলে আবার নতুন চোর এলো কোথা থেকে? আমাদের এমন ফিসফাস আলোচনায় করিমেরর মুদিদোকানের পেছনের নিমগাছে আশ্রয় নেওয়া সেই কাকটার ঝিমুনি কেটে যায়। সব দেখেশুনে আমাদের মতো তারও ভাবনা হয় যে, ওরস শোনার মতো পুণ্যি না করে করিমের দোকানে চুরি করে কোন শালা এমন পাপ করল?
কাকটা আমাদের মতো ভাবে বটে, কিন্তু সে এতই বিরক্ত হয় যে আর নিমগাছে বসে থাকে না, ‘কা-কা-কা’ রব ছেড়ে উড়ে যায়। যেন তার বিরক্তি প্রকাশ করে। কাকটা অমন বিরক্তি প্রকাশ করতে করতেই ভোর ভোর আমাদের গোটা গ্রামটাকে এক চক্কর মেরে শেষ পর্যন্ত এসে বসে মুন্নি বেওয়ার আঙিনায় টানানো কাপড় শুকানোর তারটানার ওপর। তবু তার বিরক্তি কাটে না, ‘কা-কা-কা’ ডাক ছাড়ে তিনবার। মুন্নি বেওয়া তাকে পাত্তা দেয় না। কিংবা মুন্নি বেওয়া তার ডাক শুনতে পায় না। এতে কাকটা খুব অবাক হয়। অন্যদিন তারে এসে বসতে না বসতেই মুন্নি বেওয়া ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে তাকে তাড়া দেয়। আজ তবে কী হলো? মুন্নি বেওয়া বেরিয়ে আসছে না কেন? তাকে তাড়া দিচ্ছে না কেন? মুন্নি বেওয়া কি তাহলে বাড়িতে নেই?
কাকটা ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক দেখে। ওদিক দেখে। সেদিক দেখে। না, শুধু মুন্নি বেওয়া নয়, বাড়ির অন্যেরাও তার চোখে পড়ে না। সে শুধু দেখতে পায়, বাড়িটা একেবারে সুনসান। মুন্নি বেওয়া তো নেই, সঙ্গের বিড়ালটাও নেই। এমনকি মুরগি কটাও নেই। একটা কালো কুকুর ছিল, সেটিও নেই। এককথায় কেউ কোথাও নেই। এমনকি কারো গায়ের গন্ধ পর্যন্ত নেই মুন্নি বেওয়ার বাড়ির আঙিনার বাতাসে।
এবারে কাকটা শুধু অবাকই হয় না, সে রীতিমতো চিন্তায় পড়ে যায়। চিন্তা মানে যাকে বলে একেবারে মহাদুশ্চিন্তা। মুন্নি বেওয়ার সেই যৌবনকালে বদনাম হওয়ার পর তার স্বামী আত্মহত্যা করেছিল। তারপর থেকে সারাদিন সে বাড়িতেই থাকত। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত বারান্দার পাতা চৌকিতে শুয়ে কিংবা বসে আপনমনে শুধু ভদর ভদর করে যেত। বিড়াল, মুরগি, কুকুর – সবার শুধু কানের মাথা খেত না, কারো কোনো কিছু বেচাল দেখলেই হাবেভাবে রাক্ষুসি হয়ে উঠত। আর সন্ধে নামলেই সে হয়ে যেত জান্নাতের হুর। সেই মুন্নি বেওয়ার হঠাৎ করে কিছু হলো না তো?

মাথায় একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে কাকটা আঙিনায় টানানো তার ছেড়ে নেমে আসে বারান্দায়। মুন্নি বেওয়ার চৌকিটাকে দেখে। চৌকিটা যেমন থাকে, তেমনি আছে। বিছানাটাও পাতা আছে পরিপাটি করে। শুধু মুন্নি বেওয়ার শ্বাসপ্রশ্বাস নেই কোথাও।
তাহলে কী …
কাকটার কেমন আশঙ্কা হয়! ভয়ে-কৌতূহলে সে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় মুন্নি বেওয়ার ঘরটার দিকে। ঘরের দরজা খোলা। খুব অনায়াসে সে চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। কিন্তু তারপর যা দেখে, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না, মুন্নি বেওয়া সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে গলায় শাড়ি জড়িয়ে সিলিংয়ে ঝুলে আছে। ফাগুনের মৃদু বাতাসে তার শরীর দোলা খাচ্ছে।
মুন্নি বেওয়ার বাড়িতে এই প্রথম একা কাক খুব ভয় পায়। বদনাম হওয়ার ভয়। মুন্নি বেওয়ার বদনাম ছিল, তবু সে আসত। এলে শান্তি পেত। কিন্তু আজ কোথায় শান্তি? সে যে রীতিমতো অশান্ত হয়ে উঠছে।

কাকটা এই প্রথম বুঝতে পারে, জীবনে তাহলে এমন শূন্যতাও আসে। কোনো মানুষেরই কান্না কোথাও শোনা যায় না। মানুষের কান্না শুধু নীরব হাহাকার হয়ে ভেসে বেড়ায় আকাশে-বাতাসে। আর হাহাকার-মেশানো সেই আকাশে-বাতাসে তাকে উড়ে বেড়াতে হয়। জিবনের অন্তরালে সবাই একাকি একটা সময় হারিয়ে যায়। হয়তো এটাই তার জীবনের নিয়তি।
Follow me on Facebook Fahim RIfat

Comments

  1. অসাধারণ ভাই �� প্রথমে বুঝিই নাই কি পড়তেছি লাস্ট এ এসে সব সামনে চলে আসলো

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

Facebook Avatar ব্যবহার করা নাকি হারাম কিন্তু কেন এই মতবাদ?

বন্ধুত্ব ও বাস্তবতা | পর্ব - ১

Less is More : The way of Minimalistic Lifestyle